Sunday, September 8, 2013

সৌরবিদ্যুত, শিক্ষা স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র- দুর্গম চর এখন আদর্শ গ্রাম

প্রতিকূলতাকে জয় করেছে যমুনা পারের মানুষ
যমুনার তীর আর যমুনার ভেতরের চরগ্রাম নিয়ে কতই কথা! যমুনা একমাত্র নদী যাকে বশে আনতে পানি বিজ্ঞানীদের ঘাম ঝরে যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সে-ই কবে মুঘল সম্রাট শাহজাহান প্রেমের সমাধি গড়তে যত অর্থ ব্যয় করেছেন তার সিংহভাগই ব্যয় হয়েছে তাজমহলের প্রতিচ্ছবি যমুনায় ফেলতে এই নদীর গতি নিয়ন্ত্রণে।

১৫ শতকের পর বিংশ শতকের শেষ ভাগে এ দেশে হার্ডপয়েন্ট বানাতে এবং সেতু গড়তে যমুনা শাসনের জন্যও বহু অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়। সেই যমুনার চরে এখন পাকা সড়ক। পল্লী বিদ্যুত না গেলে কী হবে এলাকা ও চরের মানুষ সোলার প্যানেল বসিয়ে সৌরবিদ্যুত সুবিধা নিয়েছে। বন্যা ও ভাঙ্গন ঠেকানোর জন্য নির্মিত বাঁধকে শক্তিশালী করে পাকা সড়ক হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে। নির্মিত হয়েছে রিভেটমেন্ট। এই সড়কে টেম্পো, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মিনি ট্রাক, মিনিবাস চলাচল করে। কৃষক নৌ ও সড়ক পথ ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পেয়ে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছে। যমুনার সঙ্গী হয়ে আছে বাঙালী নদী। তবে সারিয়াকান্দি ও সোনাতলায় আগের দেখা যমুনা পারের সঙ্গে বর্তমানে অনেক পরিবর্তন।

লোকজন বংশপরম্পরায় শুনে এসেছে- একটা সময় ছিল যখন কেউ সকালে সারিয়াকান্দির উদ্দেশে রওনা দিলে তেজোদীপ্ত কণ্ঠে গন্তব্যের নাম বলত। ফেরার সময় কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞেস করলে ক্লান্তির ঘূর্ণিপাকে ভুলেই যেত। যেতেই লাগত ২-৩ দিন। দুর্গম বন্ধুর এই পথ ধরে ফেরা। যমুনা এখন আর প্রমত্তা নেই। জলবায়ুর পরিবর্তনে যমুনাকে চেনা এখন কঠিন। অনেক স্থানে যতদূর চোখ যায় শুধু ধু-ধু বালিচর।

তারপরও অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকতে যমুনার পারের মানুষ গ্রাম ও চরগ্রামগুলোকে সাজিয়ে নিচ্ছে নিজের মতো করে।
চার বছর আগেও এই এলাকার লোক বুঝতে পারেনি তাদের পথঘাট, কৃষি কার্যক্রমের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ কত দ্রুত পালাবদল ঘটাতে পারে। খেয়াঘাটের মাঝি থেকে গাঁয়ের কৃষক, কিষানী, গাঁয়ের বধূূ সবার হাতে মোবাইল ফোন তো আছেই অনেক তরুণ-তরুণী ল্যাপটপ, মডেম নিয়ে কাজ করে দূরের চরেও। পৌর এলাকা, ইউনিয়ন পরিষদ, গ্রাম ছাড়াও চরের পাকা সড়ক ধরে মোটরসাইকেলে চেপে চলাচল করে এলাকার লোক।
বগুড়া জেলা প্রতিষ্ঠার পর সারিয়াকান্দি ছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় থানা। পূর্বদিকের বৃহত্তর ময়মনসিংহের ৩৯টি ও উত্তরদিকের বৃহত্তর রংপুরের ১শ' ২টি গ্রাম ছিল সারিয়াকান্দির মধ্যে। এই সারিয়াকান্দি ভেঙ্গে হয়েছে তিনটি থানা। সর্বশেষ ১৯৮১ সালে সারিয়াকান্দি থানা থেকে ২টি ইউনিয়ন সোনাতলা থানায় অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে সারিয়াকান্দির ১৩ ইউনিয়নের মধ্যে কাজলা, কর্নিবাড়ি, চালুয়াবাড়ি ও বোহাইল এই ৪ ইউনিয়ন যমুনার বক্ষে সম্পূর্র্ণই চর। সারিয়াকান্দি সদর, হাটশেরপুর ও চন্দনবাইশা আংশিক চর।

প্রকৃতির প্রতিকূলতার মধ্যে যমুনা পারের হাজারো মানুষকে আলোর পানে পথ চলার হাত সম্প্রসারিত করেছেন ওই এলাকার সংসদ সদস্য মোঃ আব্দুল মান্নান। জনগণ তথ্য অধিকার নিয়ে তাঁকে জবাবদিহিতার আওতায় এনেছেন। সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা এলাকার মানুষ এখন প্রতিটি কাজে সংসদ সদস্যের কাছে জবাবদিহিতা চাইতে পারেন। সেই দুয়ার তিনি খুলে দিয়েছেন। অনেক সময় তিনি নিজেই জাবাদিহিতা করেন এবং বলেন জবাবদিহিতাই রাজনীতির প্রধান শর্ত। তাঁর সহযোগিতায় এলাকার উন্নয়ন কর্মকা-ে সদর থেকে নদীপথে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের কর্নিবাড়ি, চালুয়াবাড়ির মানিকদাইর, কাজলার পাকেরদহ চর গ্রামগুলোতে পাকা সড়ক হয়েছে।

সারিয়াকান্দি সদরের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণের দিকে এবং পূর্বদিকের এলাকাগুলো সংযুক্ত হয়েছে চরের সঙ্গে। নদীপথে এসব চরে যেতে শ্যালোইঞ্জিনচালিত নৌকায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। তারপর চরে গিয়ে পাকা সড়ক। সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে দূরের বোহাইল ইউনিয়নের ধারাবর্ষার মানুষ। পাকা সড়ক সংযোগ স্থাপন করেছে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরের পাশের জামালপুর জেলার সঙ্গে। এলাকার কৃষক বড় হাটগুলো কাছে পায়। এলাকার লোকজন বলেন, তাঁরা সরাসরি এমপির কাছে গিয়ে উন্নয়নের দাবি জানান। এভাবে দুর্গম এলাকাতেও আদর্শ গ্রামের অবকাঠামো, বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, হাটের শেড হয়েছে।

বেকার যুবক ও গ্রামের নারী স্বাবলম্বী হতে হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালনের পাশাপাশি কুটির শিল্প স্থাপনে এগিয়ে এসেছে। সহযোগিতা দিচ্ছেন স্থানীয় এমপি। সারিয়াকান্দির চরগ্রামগুলো মরিচ আবাদের অন্যতম এলাকা। কনজুমার গুডসের উৎপাদকরা মরিচ কিনতে এই এলাকাতেই পারচেজ সেন্টার খুলেছে।
বিদ্যুত সঙ্কটে যখন শহুরে জীবন দুর্বিষহ তখন সৌরবিদ্যুত যমুনার দুর্গম চরগ্রামের মানুষের জীবন আলোকিত করছে।

চরের মানুষ টিভি দেখছে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে, এমনকি রাতের বেলা আঙ্গিনায় আলো জ্বালিয়ে ফসল মাড়াইও হচ্ছে। বিদ্যুত চরবাসীর জীবনমান বদলে দিয়েছে। যমুনার বুকে জেগে ওঠা চরগ্রামগুলোতে মানুষ প্রমাণ করেছে অস্তিত্বের জন্য লড়াই করে কিভাবে উন্নয়নের ধারা ধরে রাখা যায়। ভরা চাঁদের প্রতিচ্ছবি যমুনায় পড়লে তার নাচনও দেখে যমুনা পারের মানুষ।

1 comment: